দোলা
১৯শে বৈশাখ, ১৩৭১ - ১লা পৌষ, ১৪২২
দোলা আমাদের দুইবোন ও আটভাইয়ের সবার ছোটভাই এবং আমার একমাত্র ছোট ভাই। প্রকৄতির এক বিচিত্র খেয়ালে ওর জীবন জন্ম থেকেই স্বাভাবিকতা বঞ্চিত। চিকিৎসা শাস্ত্রে Down Syndrome.
খুব ছোটবেলায় আমি কিন্তু ওর অস্বাভাবিকতা বুঝতে পারতাম না। ও ছিল আর সবার ছোটভাইয়ের মতই আমার ছোট্ট একটা ভাই। ও ছিল আমার খেলার সাথী। ছেলেবেলার সব খেলাই ওর সাথে খেলেছি স্বাভাবিক আনন্দ ও উদ্যমে। সব খেলাতেই ও সমান আগ্রহী ছিল। অনেক খেলাই পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও উপভোগ করতো খুবই - অংশগ্রহনই ছিল ওর সবচেয়ে আনন্দের।
ব্যাপারটা আমি এখন বুঝতে পারি। আমরা ভাইয়েরা যা কিছু করতাম তার সবকিছুই ও করতে চাইতো। খেলাধূলা, বেড়ানো, লেখাপড়া, স্কুলে যাওয়া- সবকিছু। স্কুলে আমাদের শিক্ষকেরা ওকে খুবই স্নেহ করতেন। শান্ত, ঝামেলাহীন, মিশুক ও সুদর্শন আমার ভাইটির মেধার অভাব কখনোই শিক্ষকদের স্নেহের অন্তরায় হয়নি। এজন্য আমি তখনকার শিক্ষকদের আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই। স্কুলের একটি ঘটনা উল্লেখ না করে পারছিনা। অন্যান্য ছাত্রেরা কোন কারনে শিক্ষকের বেতের শিকার হলে ও নিজের হাতটিও বড়িযে দিতো- সবার মতো একজন হবার ইচ্ছেটা ছিলো ওর এমনই প্রবল।
আমরা সবাই একে একে বাড়ী ছেড়ে চলে যাবার পর ওর মানষিক বিকাশ কমে যেতে থাকে। প্রতিদ্বন্দিতাহীন এবং প্রায় বৈচিত্র্যহীন হয়ে যায় ওর জীবন। কিছু ব্যতিক্রমের একটি হলো মার সাথে আমার বিয়েতে ওর আমেরিকায় আসা। ওর আমেরিকার দিনগুলি আমার জীবনের এক অনন্য সুখস্মৃতি। বউভাত অনুষ্ঠানে ও নেচেছিল পর্যন্ত।
আমাদের মা জীবনের শেষাবধি ওকে অতিআদরে নিজের কাছে রেখেছেন। গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় এসেও দোলা মায়ের স্নেহছায়াতেই ছিল। তারপর ঢাকায় এবং নিজবাড়ীতে দাদাবৌদিদের স্নেহছায়ায়। বেশি কিছু চাহিদা ছিল না। গান ভালবাসত, ফুল ভালবাসত- সবচেয়ে ভালবাসত ওর আশপাশের মানুষদের। প্রকাশ করতে না পারলেও ওর ভালবাসার ছোয়া যারা পেয়েছে তারা জানে ওর মনটা কত সুন্দর ছিল।
আজ দোলা আমাদের মাঝে নেই। ওর জন্য কষ্ট হয়। নিজের কোন দোষে নয়- প্রকৃতির খেয়ালে আমাদের ভাইটিকে মাণবজীবনের অধিকাংশ সুখ-আনন্দ বঞ্চিত হতে হলো। তবে প্রাপ্তি যে কিছুই ছিল না তা নয়। সারাজীবন আপনজনের সান্নিধ্য ছিল, জীবনের শেষদিনে নিজগৃহে আপণ ভাইয়ের পরিবেশনায় শেষ আহার এবং নিজ বিছানায় নিজের মতো করে কাউকে বিরক্ত না করে চলে যাওয়াটাও একটা অর্জন। ওর জীবনটা যদি একটা নাটক হয় তবে শেষ দৃশ্যটা একেবারেই ওর নিজস্ব রচনা।
দোলার সাথে শেষবার দেখা হবার পর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। ওর জীবনের শেষ বছরগুলোতে ওকে দেখতে যেতে পারিনি- ওর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া বা শ্রাদ্ধানুষ্ঠানেও উপস্থিত থাকতে পারিনি। তবে আপনাদের অনেকেই অতিব্যস্ততার মাঝেও ওর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া -শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে ওর প্রতি যে অকৃত্রিম ভালবাসা দেখিয়েছেন সেটা ওর অতিবঞ্চিত জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি এবং অনন্তপথচলায় একমাত্র পাথেয়। এজন্য আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
মুকুল দাস, মেরীল্যান্ড, ইউ এস এ।